সচিবালয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে ২ ও ৩ নম্বর ফটক ধরে প্রবেশ করলে ভেতরের সুউচ্চ ভবনগুলোর মধ্যে ইডেন ভবন হিসেবে পরিচিত পুরোনো ভবনটি চোখে পড়বে; বুধবার গভীর রাতে যেখানে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে এক মাথা থেকে আরেক মাথায়।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র এ ভবন ৭ নম্বর ভবন হিসেবেও পরিচিত; যেটির পূর্ব দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নতুন বহুতল ভবন আর পশ্চিম দিকে জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ ভবন।
বুধবার রাত প্রায় ২টার দিকে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট প্রায় ১০ ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। ততক্ষণে বহুতল ওই ভবনের অন্তত চারটি তলায় থাকা পাঁচটির বেশি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথি, চেয়ারটেবিল, এসি, কম্পিউটার ও অন্যান্য আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। তবে কতটা পুড়েছে তা তদন্ত কমিটি কাজ গুছিয়ে আনার পরই সুস্পষ্ট হবে।
আগুন নেভাতে গিয়ে সড়কে ট্রাক চাপায় ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মীও নিহত হয়েছেন।
আগুনে ওই ভবনের পরিবেশ কাজের অনুপযোগী হওয়ায় সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আর সচিবালয়জুড়ে বিদ্যুৎ না থাকায় অন্যান্য ভবনেও কাজ হয়নি।আগুন লাগা সাত নম্বর ভবনের নবম তলার পুরোটা জুড়ে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের দপ্তর। আগুনে এ দপ্তরের পূর্বপশ্চিমমুখী করিডর পুরোপুরি ভস্মিভূত হয়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, করিডরের উত্তর ও দক্ষিণ পাশের রুমগুলোর কোনটি পুরোপুরি আবার কোনটি আংশিক ভস্মিভূত হয়েছে। তবে করিডরের সিলিং ও দুইপাশের সাজসজ্জা ধ্বংস হওয়ায় তা হাঁটাচলার অনুপযোগী হয়ে গেছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগুন লাগার পর তাদের কেউ মন্ত্রণালয়ের ঢোকার অনুমতি পাননি। সেখানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে যাওয়ার অবস্থাও ছিল না।
আগুন নিভে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার আর কাউকে এ ভবনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটির সদস্যদের পাশাপাশি উপদেষ্টাদের কয়েকজন অল্প কিছুটা ঘুরে দেখেছেন।
ভবনের অষ্টম তলার পূর্ব অংশে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কয়েকটি দপ্তর রয়েছে। আরও রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দপ্তর।
এই তলার পশ্চিম অংশজুড়ে রয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের দপ্তর। তার দপ্তর ও আশপাশের রুমগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা।
অন্যদের মত তিনিও বৃহস্পতিবার তার বিভাগে যেতে পারেননি। তবে সেখানকার ভিডিও থেকে দেখা অভিজ্ঞতার আলোকে এই কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টার দপ্তর পুরোপুরি ভস্মিভূত হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছেন। পাশের রুমগুলোও পুড়ে গেছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো. মুশফিকুর রহমানের একান্ত সচিব মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান বলেন, ”নিরাপত্তাজনিত কারণে সারাদিনে নিজ দপ্তরে যেতে পারিনি। সচিব মহোদয়ের রুমটা পাঁচ তলায় আর উপদেষ্টা মহোদয়ের রুম সাত তলায়। পাঁচ তলার দিকে আগুন ছড়ায়নি বিধায় এখানে ক্ষয়ক্ষতি কম। আগুন নেভাতে গিয়ে কিছু পানি হয়তো এসেছে। তবে উপদেষ্টা মহোদয়ের দপ্তরের দিকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে শুনেছি।”
পুরো সপ্তম তলাজুড়ে রয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; যেটির উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আগুনে এ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের অধিকাংশ জিনিসপত্র জুড়ে গেছে বলে উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন।
ষষ্ঠ তলায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও রয়েছেন আসিফ মাহমুদ।
শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ”আমরা ঘটনাস্থলের কোনো ছবি বা ভিডিও পাইনি। তবে শুনেছি অনেক কক্ষ সম্পূর্ণ আবার কোনোটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
অগ্নিকাণ্ডে কয়টা মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়েছে এবং পুড়ে যাওয়া নথিপত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে কি না জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, প্রায় পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে গেছে।
“ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, সড়ক ও জনপদ বিভাগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নথি কার্যক্রম অনলাইনে থাকার কারণে আমরা উদ্ধার করতে পারব।”
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পুরোটাই অ্যানালগ পদ্ধতিতে ফাইল করার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “তাই যে শাখাগুলোর নথিগুলো পুড়ে গেছে, সেগুলো কতটা রিকভার করা যাবে তা নিরুপণ করার জন্য মন্ত্রণালয় পর্যায়ে একটা কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটি কাজ করে প্রতিবেদন দিলে আমরা বুঝতে পারব, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কোনটা ফিরে পাওয়া সম্ভব আর কোনটা সম্ভব নয়।”
বুধবার রাত প্রায় ২টার দিকে সচিবালয়ে আগুন লাগার খবর সংবাদমাধ্যমে ছড়াতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট প্রায় ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং পরের চার ঘণ্টায় তা পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ভবনটির ৬, ৭, ৮, ৯-এ চার তলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি, সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল দিনের বেলায় সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি- তিনটি জায়গায় একসাথে আগুন দেখা গেছে।”
সরকারের উপদেষ্টা আসিফ আগুন লাগার খবর শুনে উত্তরবঙ্গে তার তিন দিনের সফর সংক্ষিপ্ত করে ঢাকায় ফিরে এসেছেন। এসময় তিনি ফেইসবুকে এক পোস্টে লেখেন, ”আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো জানা যায়নি। আমাদেরকে ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না “
সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডে ভবনের ক্ষয়ক্ষতির ধরন জানতে পারেনি এর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তর।
কারণ হিসেবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পুড়ে যাওয়া কক্ষগুলোয় প্রবেশ করতে না পারার কারণে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যায়নি।
অধিদপ্তরের ’ইডেন’ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুস সাত্তার বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবনের কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে, কতটা ক্ষতি হয়েছে, সেটি এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
“ভবনটি এখনও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আছে। এ কারণে আমরা সেখানে এখনও যেতে পারছি না। তদন্ত কমিটি হয়েছে; শুধু তারাই ঢোকার অনুমতি পাচ্ছেন। তারা সেখানে গেলে বুঝতে পারবেন, কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে।”
তদন্ত কমিটির সদস্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে বলেন, “বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। বিকালে (বৃহস্পতিবার) আমরা গিয়েছিলাম। অন্ধকার হয়ে গেছে, সে কারণে দেখা সম্ভব হয়নি। আমরা এখনও ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয়েছে তা নির্ধারণ করতে পারিনি।”
– বিডিনিউজ২৪
আপনার মতামত লিখুন :